বিশ্বকে বদলে দেওয়া সংঘর্ষ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ
মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বৃহত্তম এবং বিধ্বংসী সংঘর্ষ ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ । ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত চলা এই যুদ্ধের সময় প্রায় পুরো বিশ্বই কোনো না কোনোভাবে এর সাথে জড়িয়ে পড়েছিল। এই যুদ্ধ কেবল সামরিক নয়, মানবিক, রাজনৈতিক, এবং অর্থনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। যুদ্ধে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু, ধ্বংস, এবং জাতির পুনর্গঠন ইতিহাসে গভীর চিহ্ন রেখে গেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ, অক্ষশক্তি ও মিত্রশক্তির ভূমিকা, এবং এর বিশ্বব্যাপী প্রভাব সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন। ইতিহাসের এই অধ্যায়ের গভীর বিশ্লেষণ।
কবে হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর, যখন নাৎসি জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমণ করে। এর জবাবে যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এর পরের ছয় বছর ধরে চলা এই যুদ্ধ শেষে ১৯৪৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর, জাপানের নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মাধ্যমে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।
আরও জানুন – প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কাদের মধ্যে হয়েছিল?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মূলত দুটি জোটের মধ্যে সংঘটিত হয়েছিল:
- অক্ষশক্তি (Axis Powers): এর মধ্যে প্রধান দেশগুলো ছিল জার্মানি, ইতালি এবং জাপান। এই দেশগুলো আক্রমণাত্মক সাম্রাজ্য বিস্তারের নীতি গ্রহণ করেছিল এবং তাদের মধ্যে একটি শক্তিশালী সামরিক ও রাজনৈতিক জোট ছিল।
- মিত্রশক্তি (Allied Powers): মিত্রশক্তির মধ্যে প্রধান দেশগুলো ছিল যুক্তরাজ্য, সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, চীন, এবং আরও কয়েকটি দেশ। তারা একসঙ্গে কাজ করে অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণঃ
২য় বিশ্বযুদ্ধের পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ কাজ করেছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কারণগুলো হলোঃ
- প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরিণতিঃ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে জার্মানিকে কঠোর শর্তে বাধ্য করা হয়েছিল, বিশেষত ভার্সাই চুক্তি অনুযায়ী। এর ফলে জার্মানিতে জাতীয়তাবাদ ও প্রতিশোধের মনোভাব সৃষ্টি হয়, যা হিটলার এবং তার নাৎসি পার্টির উত্থানের পথ সুগম করে।
- ফ্যাসিবাদ এবং নাৎসিবাদের উত্থানঃ ইতালিতে বেনিতো মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট সরকার এবং জার্মানিতে হিটলারের নাৎসি শাসন যুদ্ধের প্রধান কারণ ছিল। তারা আক্রমণাত্মক বিদেশ নীতি গ্রহণ করে, যেটি ইউরোপে উত্তেজনা বাড়ায়।
- অর্থনৈতিক বিপর্যয়ঃ ১৯৩০ সালের মহামন্দার সময় বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয়, যা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং চরমপন্থী মতবাদের বিস্তার ঘটায়।
- আন্তর্জাতিক জোট এবং চুক্তিঃ লিগ অফ নেশনস এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলোর কার্যকারিতা ব্যর্থ হয়, যা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ায়। বিশেষত, মিউনিখ চুক্তি ও অন্যান্য আলোচনার মাধ্যমে আগ্রাসী শক্তিগুলিকে শক্তি প্রদর্শনের সুযোগ দেয়া হয়েছিল।
- জার্মানি ও সোভিয়েত চুক্তিঃ ১৯৩৯ সালে হিটলার ও স্তালিনের মধ্যে স্বাক্ষরিত মোলটভ-রিবেনট্রপ চুক্তি অনুযায়ী পোল্যান্ডকে দুই ভাগে বিভক্ত করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল, যা যুদ্ধের পথ আরও প্রশস্ত করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রধান ঘটনাঃ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কয়েকটি প্রধান ঘটনা ছিল যুদ্ধের গতিপথ নির্ধারণকারী এবং ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে:
- পোল্যান্ড আক্রমণ (১৯৩৯): জার্মানির পোল্যান্ড আক্রমণের মাধ্যমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়।
- ব্রিটেনের যুদ্ধ (Battle of Britain): ১৯৪০ সালে জার্মানি যুক্তরাজ্যের উপর ব্যাপক বিমান হামলা চালায়, যা যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে পরিণত হয়।
- স্টালিনগ্রাদের যুদ্ধঃ ১৯৪২-৪৩ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের স্টালিনগ্রাদ শহরে জার্মান বাহিনীর পরাজয় ঘটে, যা পূর্ব ফ্রন্টে মিত্রশক্তির জয় নিশ্চিত করে।
- ডি–ডে (D-Day): ১৯৪৪ সালের ৬ জুন নর্ম্যান্ডি উপকূলে মিত্রশক্তির অভিযান ইউরোপের মুক্তির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
- হিরোশিমা ও নাগাসাকি পরমাণু বোমা হামলাঃ ১৯৪৫ সালের আগস্ট মাসে যুক্তরাষ্ট্র জাপানের উপর দুইটি পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করে, যার ফলস্বরূপ জাপান নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাবঃ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারীঃ
- মানবিক ক্ষতিঃ প্রায় ৭ কোটি মানুষ নিহত হয়, যার মধ্যে অনেক বেসামরিক নাগরিক।
- অর্থনৈতিক ধ্বংসঃ ইউরোপ ও এশিয়ার অনেক শহর ও অবকাঠামো সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়।
- রাজনৈতিক পরিবর্তনঃ সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র সুপারপাওয়ার হিসেবে উঠে আসে, শুরু হয় ঠান্ডা যুদ্ধ।
- উপনিবেশিক ব্যবস্থার পতনঃ যুদ্ধের পর অনেক উপনিবেশ স্বাধীনতা লাভ করে।
- জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠাঃ ভবিষ্যতে বিশ্বযুদ্ধ রোধে জাতিসংঘ গঠিত হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলাফলঃ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কয়েকটি প্রধান ফলাফল হলোঃ
- জার্মানির পরাজয় ও বিভক্তিঃ জার্মানি যুদ্ধের শেষে পরাজিত হয় এবং দেশটি পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানিতে বিভক্ত হয়। পশ্চিম জার্মানিতে গণতান্ত্রিক সরকার গঠন হয় এবং পূর্ব জার্মানি সোভিয়েত শাসনের অধীনে থাকে।
- জাপানের আত্মসমর্পণঃ হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা হামলার পরে জাপান নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে। যুদ্ধের শেষে জাপান তার সাম্রাজ্যবাদী নীতি পরিত্যাগ করে এবং পশ্চিমা শাসন গ্রহণ করে।
- স্নায়ুযুদ্ধের সূচনাঃ সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে মতাদর্শগত সংঘাত শুরু হয়, যা প্রায় চার দশক ধরে চলা স্নায়ুযুদ্ধের পথ তৈরি করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের ভূমিকাঃ
অ্যাডল্ফ হিটলার ছিলেন নাৎসি জার্মানির স্বৈরশাসক। তার নেতৃত্বে জার্মানি ইউরোপের অধিকাংশ দেশ আক্রমণ ও দখল করে। হিটলারের ইহুদি-বিরোধী নীতি ও “হলোকাস্ট” চলাকালে লক্ষ লক্ষ ইহুদি ও অন্যান্য সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী নির্মমভাবে নিহত হন।
আরও জানুনঃ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মানবিক ক্ষয়ক্ষতিঃ
ইতিহাসের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ছিল এই বিশ্বযুদ্ধ । এতে প্রায় ৭ কোটিরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছিল, যার মধ্যে অনেকেই ছিল বেসামরিক নাগরিক। বিশেষত হলোকাস্টের সময় প্রায় ৬০ লক্ষ ইহুদি ও অন্যান্য সংখ্যালঘু জাতিগত গোষ্ঠী নির্মমভাবে গণহত্যার শিকার হয়েছিল।
রাজনৈতিক পরিবর্তন ও স্নায়ুযুদ্ধের সূচনাঃ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক প্রভাব ছিল স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা। যুদ্ধের পর বিশ্বের দুটি প্রধান পরাশক্তি হয়ে উঠে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন। তাদের মধ্যে মতাদর্শগত ও সামরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়, যা স্নায়ুযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে প্রায় চার দশক ধরে বিশ্বকে প্রভাবিত করে।
জাতিসংঘের সৃষ্টিঃ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞের পর বৈশ্বিক শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ১৯৪৫ সালে জাতিসংঘ গঠিত হয়। এই সংস্থাটি এখনও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, মানবাধিকার, এবং বৈশ্বিক শান্তিরক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।
আরও জানুনঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ১০টি গুরুত্বপূর্ণ সত্য যা আপনি জানেন না
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উপসংহারঃ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী ও বিধ্বংসী সংঘর্ষ, যা পুরো বিশ্বকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। এই যুদ্ধের ফলে বহু দেশ পুনর্গঠিত হয়, বিশ্বের মানচিত্র পরিবর্তিত হয় এবং আধুনিক বৈশ্বিক শক্তির ভারসাম্য রূপান্তরিত হয়। জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠা এবং যুদ্ধ-পরবর্তী নতুন বিশ্বব্যবস্থা যুদ্ধ থেকে শিক্ষা গ্রহণের চেষ্টা করেছিল। আজও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আমাদের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষার আধার, যা থেকে বিশ্ব শান্তির জন্য সমন্বয় এবং সংলাপের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আমাদের আরও গভীর উপলব্ধি করা উচিত।
[…] :: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ: ইতিহাসের সবচেয়… প্রাকৃতিকভাবে ফর্সা হওয়ার সহজ […]
[…] আরও জানুনঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ: ইতিহাসের সবচেয়… […]