প্রাচীন যুগে মানুষ তাদের সংস্কৃতি, ধর্মীয় বিশ্বাস এবং শাসকদের স্মরণে তৈরি করেছিল অসাধারণ স্থাপত্য নিদর্শন, যেগুলোকে প্রাচীন পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্য হিসেবে অভিহিত করা হয়। এসব আশ্চর্যের বেশিরভাগই কালের বিবর্তনে বিলুপ্ত হয়েছে, কিন্তু এগুলোর ইতিহাস এখনও আগের মানুষের জ্ঞান ও সৃষ্টিশীলতার সাক্ষ্য বহন করে। আসুন, আদি পৃথিবীর সেই সপ্তম আশ্চর্য গুলো সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।
গিজার পিরামিড, প্রাচীন পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্য এবং মিশরের অসাধারণ স্থাপত্যকলা
মিশরের গিজায় অবস্থিত এই পিরামিডটি প্রাচীন বিশ্বের সপ্তাশ্চর্যের একমাত্র নিদর্শন যা আজও টিকে আছে। খ্রিস্টপূর্ব ২৫৮৪ থেকে ২৪৬৫ অব্দের মধ্যে এটি নির্মিত হয়েছিল। মিশরের ফারাও খুফুর সমাধি হিসেবে তৈরি এই পিরামিডটি চুনাপাথরের ইট দিয়ে নির্মিত, যার সংখ্যা প্রায় ২০ লক্ষ ৩০ হাজার। মিশরের মানুষ বিশ্বাস করত, মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের জন্য ফারাওদের দেহ সংরক্ষণ করতে হবে, যা এই বিশাল পিরামিড নির্মাণের প্রধান কারণ ছিল।
আরও জানুনঃ
ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান, প্রাচীন পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্য এবং প্রাচীন বিশ্বের অন্যতম বিস্ময়কর উদ্যান
ইরাকের ইউফ্রেটিস নদীর তীরে অবস্থিত ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান প্রাচীন যুগের অন্যতম বিস্ময়। যদিও বাস্তবে এটি ঝুলন্ত ছিল না, তবে উচ্চতার কারণে এই নামটি প্রচলিত হয়। সম্রাট নেবুচাদনেজার II তার প্রিয়তমা স্ত্রীর জন্য এটি নির্মাণ করেন। বিশাল আকারের এই উদ্যানের ভিতটি ছিল ৮০০ বর্গফুট এবং উচ্চতা ছিল ৮০ ফুট। বিভিন্ন প্রজাতির ফুল ও গাছপালা দিয়ে উদ্যানটি সাজানো হয়েছিল, এবং নদী থেকে পানি সরবরাহের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। দুর্ভাগ্যবশত, ৫১৪ খ্রিস্টাব্দে এটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়।
অলিম্পিয়ার জিউসের মূর্তি, পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্য এবং প্রাচীন গ্রিসের বিস্ময়কর শিল্পকর্ম
গ্রিক দেবতা জিউসের মূর্তিটি খ্রিস্টপূর্ব ৪৩২ অব্দে গ্রিক ভাস্কর ফিডিয়াস তৈরি করেন। প্রায় ৪২ ফুট উচ্চতার এই মূর্তিটি সোনা, মূল্যবান পাথর এবং হাতির দাঁতে নির্মিত হয়েছিল। দেবতার মূর্তিটি ছিল একটি কাঠের আসনে, যেখানে তার ডান হাতে ছিল একটি ছোট মূর্তি যা জয় ও জৌলুসের প্রতীক। মূর্তিটি অজানা কারণে ধ্বংস হয়ে যায়, তবে ধারণা করা হয়, খ্রিস্টীয় ৫ম শতাব্দীতে খ্রিস্টধর্মের প্রসারের সময় এটি ধ্বংস করা হয়।
দেবী আর্টেমিস মন্দির
ফসলের দেবী আর্টেমিসকে উৎসর্গ করে খ্রিস্টপূর্ব ৫৫০ অব্দে ইফেসাসে এই মন্দিরটি নির্মিত হয়। ৩৭৭ ফুট লম্বা ও ১৮০ ফুট চওড়া এই মন্দিরটি ছিল সম্পূর্ণ মার্বেল পাথরে তৈরি। মন্দিরের দেয়ালজুড়ে মণি, মুক্তা, রুবি এবং হীরা খণ্ড বসানো ছিল। ৩৫৬ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দে ‘গথা’ জাতি এটি ধ্বংস করে ফেলে। তবে পৃথিবীর এই সপ্তম আশ্চর্য ধ্বংসাবশেষ এখনো তুরস্কে পাওয়া যায়, যা ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে।
রোডসের মূর্তি, পৃথিবীর আদি সপ্তাশ্চর্য এবং গ্রীসের প্রাচীন স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন
গ্রিক দ্বীপ রোডসে নির্মিত এই মূর্তিটি প্রাচীন যুগে অন্যতম বৃহৎ ভাস্কর্য ছিল। মহাবীর আলেকজান্ডারের বিজয়ের পর, রোডসের বাসিন্দারা তাকে স্মরণ করে এই মূর্তিটি নির্মাণ করেন। ১০৫ ফুট উচ্চতার এই মূর্তিটি ১২ বছর ধরে নির্মিত হয়েছিল। খ্রিস্টপূর্ব ২২৮ অব্দে একটি ভূমিকম্পে মূর্তির একটি পা ভেঙে যায়, পরে ষষ্ঠ শতাব্দীতে সারাসিন জাতি এটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেয়।
আলেকজান্দ্রিয়ার বাতিঘর, পৃথিবীর পুরাতন সপ্তম আশ্চর্য এবং প্রাচীন মিশরের আলোকিত স্থাপত্যের বিস্ময়
মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ায় খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতাব্দীতে নির্মিত এই বাতিঘরটি ছিল বিশ্বের অন্যতম উচ্চতম স্থাপনা। নাবিকদের দিক নির্দেশনার জন্য ৪৫০ ফুট উচ্চতার এই বাতিঘরটি নির্মিত হয়। ১৪শ শতাব্দীতে এক ভূমিকম্পে এটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়, তবে পৃথিবীর এর সপ্তম আশ্চর্য ধ্বংসাবশেষ এখনো ভূমধ্যসাগরের তলদেশে পাওয়া যায়।
হ্যালিকারনেসাসের সমাধি মন্দির, পুরাতন সপ্তম আশ্চর্য এবং প্রাচীন বিশ্বের স্থাপত্যশৈলীর এক অসাধারণ উদাহরণ
তুরস্কের কারিয়া রাজ্যে খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০ অব্দে রাজা মোসোলাসের স্মরণে তার স্ত্রী রানী আর্তেমিসিয়া এই সমাধি মন্দিরটি নির্মাণ করেন। ১৩৫ ফুট উচ্চতার এই মন্দিরটি মার্বেলে তৈরি এবং তিনটি স্তরে বিভক্ত ছিল। এটি সম্ভবত এক ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়ে যায়, আর এর ধ্বংসাবশেষ লোকজন বাড়ি-ঘর বানাতে কাজে লাগিয়েছিল।
পৃথিবীর এই সপ্তম আশ্চর্য গুলো তাদের স্থাপত্যকলার জন্য পৃথিবীজুড়ে পরিচিত ছিল, আর এগুলোর প্রতিটিই প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষের সৃষ্টিশীলতা ও ঐতিহ্যের সাক্ষ্য বহন করে। যদিও বেশিরভাগই বিলুপ্ত হয়ে গেছে, তবে তাদের ইতিহাস আজও মানুষের মনে বিস্ময় জাগিয়ে রাখে।
[…] […]