প্রাচীনকাল থেকেই মানুষকে বিস্মিত করে আসা চন্দ্রগ্রহণ হলো একটি মহাজাগতিক অপূর্ব ঘটনা। চাঁদের এই পরিবর্তন শুধু বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং বিভিন্ন সংস্কৃতিতে এটি আধ্যাত্মিক এবং সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। বর্তমানে আমরা জানি, চন্দ্রগ্রহণ কোনো রহস্য নয়, বরং এটি আমাদের সৌরজগতের গ্রহ-নক্ষত্রগুলোর এক নিখুঁত প্রাকৃতিক সমন্বয়ের ফল। চন্দ্রগ্রহণ কী, কীভাবে ঘটে এবং এর প্রকারভেদ সম্পর্কে জানুন। সেই সাথে চন্দ্রগ্রহণ কখন এবং কিভাবে দেখা যায় তার সব সঠিক তথ্য পেতে আমাদের এই নিবন্ধে পড়ুন।
যখন পৃথিবী, সূর্য এবং চাঁদ একই সরলরেখায় অবস্থান করে এবং পৃথিবীর ছায়া চাঁদের উপর পড়ে, তখনই চন্দ্রগ্রহণ ঘটে। এর ফলে চাঁদ আংশিক বা পুরোপুরি অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যায়। পৃথিবী যখন চাঁদের সামনে চলে আসে, তখন সূর্যের আলো সরাসরি চাঁদের উপর পৌঁছাতে পারে না, যা গ্রহণের মূল কারণ। যেহেতু চাঁদের কক্ষপথ কিছুটা পৃথিবীর কক্ষপথের তুলনায় ঝুঁকে থাকে, তাই প্রতি মাসেই চন্দ্রগ্রহণ ঘটে না।
চন্দ্রগ্রহণ সাধারণত তিনটি ভিন্ন ধরনে দেখা যায়: পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ, আংশিক চন্দ্রগ্রহণ, এবং পেনাম্ব্রাল চন্দ্রগ্রহণ।
পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণঃ
পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ ঘটে যখন চাঁদ সম্পূর্ণরূপে পৃথিবীর গাঢ় ছায়ার (আমব্রা) মধ্যে ঢুকে যায়। এই সময় চাঁদ রক্তের মতো লালচে বর্ণ ধারণ করে, যা “রক্ত চাঁদ” নামে পরিচিত। এই দৃশ্য খুবই নাটকীয় এবং বিস্ময়কর।
আংশিক চন্দ্রগ্রহণঃ
আংশিক চন্দ্রগ্রহণ ঘটে যখন চাঁদের একটি অংশ পৃথিবীর ছায়ার মধ্যে থাকে এবং বাকি অংশ সূর্যের আলো দ্বারা আলোকিত থাকে। এর ফলে চাঁদের একাংশ অন্ধকার এবং অন্য অংশ আলোকিত হয়ে থাকে, যা আংশিক গ্রহণের সৃষ্টি করে।
পেনাম্ব্রাল চন্দ্রগ্রহণঃ
পেনাম্ব্রাল চন্দ্রগ্রহণ সবচেয়ে কম দেখা যায়। এতে চাঁদ পৃথিবীর হালকা বাইরের ছায়া (পেনাম্ব্রা) দিয়ে অতিক্রম করে, যার ফলে চাঁদের আলো কিছুটা ম্লান হয়ে যায়। এই ধরনের গ্রহণ খুব স্পষ্ট নয় এবং অনেক সময় খালি চোখে তা বোঝা মুশকিল হয়।
চন্দ্রগ্রহণের মূল প্রক্রিয়াটি পৃথিবীর ছায়ার কারণে ঘটে। পৃথিবী যখন সূর্য এবং চাঁদের মাঝখানে এসে দাঁড়ায়, তখন সূর্যের আলো সরাসরি চাঁদে পৌঁছায় না। এই ছায়া মূলত দুই ভাগে বিভক্ত: গাঢ় ছায়া (আমব্রা) এবং হালকা ছায়া (পেনাম্ব্রা)। চাঁদ যখন পুরোপুরি আমব্রার মধ্যে প্রবেশ করে, তখন পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ হয়।
প্রতি পূর্ণিমায় চাঁদ ও পৃথিবী এক নির্দিষ্ট বিন্দুতে অবস্থান করে, কিন্তু প্রতি মাসে চন্দ্রগ্রহণ হয় না। এর কারণ চাঁদের কক্ষপথ কিছুটা পৃথিবীর কক্ষপথ থেকে প্রায় ৫ ডিগ্রি কোণে ঝুঁকে থাকে। এই ঝুঁকির কারণে সূর্য, চাঁদ এবং পৃথিবী ঠিক সরলরেখায় অবস্থান না করলে গ্রহণ হয় না। শুধু তখনই চন্দ্রগ্রহণ হয়, যখন চাঁদ ও পৃথিবীর কক্ষপথ এমনভাবে সারিবদ্ধ হয় যে পৃথিবীর ছায়া চাঁদের উপর পড়ে।
চন্দ্রগ্রহণ এবং সূর্যগ্রহণের মধ্যে কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে।
ঘটনার সময়
দৃশ্যমানতা
দেখার সুরক্ষা
চন্দ্রগ্রহণ এর সময় কোনো ক্ষতিকর রশ্মি চাঁদ থেকে বের হয় না, কারণ এটি মূলত পৃথিবীর ছায়ার কারণে ঘটে। সূর্যগ্রহণের মতো এতে সরাসরি সূর্যের দিকে তাকানোর ঝুঁকি নেই, তাই খালি চোখে এটি উপভোগ করা সম্পূর্ণ নিরাপদ।
বিভিন্ন সংস্কৃতিতে চন্দ্রগ্রহণকে আধ্যাত্মিক বা ঐশ্বরিক ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অতীতে, অনেক সভ্যতা চন্দ্রগ্রহণকে কোনো অশুভ সংকেত বলে মনে করতো, যেমন যুদ্ধ বা দুর্ভিক্ষের পূর্বাভাস। তবে বর্তমানে চন্দ্রগ্রহণ শুধুমাত্র একটি প্রাকৃতিক এবং বৈজ্ঞানিক ঘটনা হিসেবে গণ্য করা হয়, যা আমাদের মহাকাশের বিস্ময়কর গতিবিধির একটি চিহ্ন।
যদি চন্দ্রগ্রহণ দেখতে চান, তবে একটি পরিষ্কার আকাশ এবং উপযুক্ত পরিবেশ প্রয়োজন। কোনো বিশেষ সরঞ্জাম প্রয়োজন হয় না। চন্দ্রগ্রহণ দেখতে চাইলে পূর্ণিমার রাতগুলোতে খোলা জায়গায় গিয়ে আকাশের দিকে তাকালেই হবে।
চন্দ্রগ্রহণ একটি প্রাকৃতিক ও মহাজাগতিক ঘটনা, যা পৃথিবীর অবস্থান, চাঁদের কক্ষপথ এবং সূর্যের আলো কিভাবে পৃথিবীতে পড়ে তার উপর নির্ভর করে। বিজ্ঞান আমাদের বুঝতে সাহায্য করেছে যে, এই ঘটনা পৃথিবী, চাঁদ এবং সূর্যের এক অসাধারণ সমন্বয়ের ফল। চন্দ্রগ্রহণ আমাদের আকাশের সৌন্দর্যের সাথে মহাবিশ্বের বিস্ময়কর গতিবিধি উপলব্ধি করার সুযোগ করে দেয়।