আডলফ হিটলার একদিনে এমন নরপিশাচ, ইহুদি নিধনের প্রতীক হয়ে ওঠেননি। তার জীবনে এমন কিছু বিশেষ ঘটনা ঘটেছিল যা তার মনোজগতকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। হয়তো এই ঘটনাগুলো না ঘটলে, আমরা কখনোই হিটলারের মতো এক নিষ্ঠুর ব্যক্তির সম্মুখীন হতাম না। এখানে আমরা হিটলারের জীবনের কিছু প্রধান ঘটনা ও তার না থাকার ফলে পৃথিবীর চেহারা কেমন হতে পারত, তা নিয়ে আলোচনা করব।
১) শৈশব ও আর্টিস্ট হওয়ার স্বপ্নঃ
আডলফ হিটলার জন্মগ্রহণ করেন ১৮৮৯ সালে অস্ট্রিয়ার একটি সাধারণ পরিবারে। তার ছোটবেলায় স্বপ্ন ছিল শিল্পী হওয়ার। ১৯০৯ সালে, মাত্র ২০ বছর বয়সে তিনি ভিয়েনায় পাড়ি জমান, যেখানে তার লক্ষ্য ছিল বিখ্যাত আর্ট কলেজে ভর্তি হওয়া। দুর্ভাগ্যবশত, সেই কলেজে শুধুমাত্র অভিজাত রোমান ক্যাথলিকরা ভর্তি হতে পারত। হিটলার neither ছিল অভিজাত nor রোমান ক্যাথলিক, ফলে তাকে ভর্তি হতে দেওয়া হয়নি। যদিও তার শৈল্পিক প্রতিভা ছিল অসাধারণ, এই ঘটনা তার জীবনে বড় ধাক্কা দেয়। ভাবুন তো, যদি হিটলার সেই আর্ট কলেজে ভর্তি হতে পারতেন, তাহলে হয়তো ইতিহাসের চিত্র ভিন্ন হতো।
আরও জানুনঃ হিটলারের জীবনী ইতিহাসের এক বিভীষিকাময় অধ্যায়
২) ইহুদি বিদ্বেষের সূত্রপাতঃ
বেশিরভাগ মানুষের ধারণা, হিটলারের ইহুদি বিদ্বেষের কারণ ছিল ইহুদিদের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক আধিপত্য। কিন্তু এর পিছনে আরও ব্যক্তিগত কারণ ছিল। ভিয়েনায় পড়াশোনা করতে না পেরে হতাশ হিটলার এক ইহুদি পরিবারের এক মেয়ের প্রেমে পড়েন। সেই মেয়েটির পরিবার ছিল অত্যন্ত রক্ষণশীল ইহুদি, এবং তার সাথে খ্রিস্টানদের মেলামেশা সীমিত ছিল। হিটলার অনেক চিরকুট পাঠালেও, মেয়েটির পরিবারের কঠোরতা তাকে মনোমালিন্যে ফেলে। একটি বিশেষ ঘটনার পর তার মনে ইহুদিদের বিরুদ্ধে তীব্র বিদ্বেষ জন্ম নেয়, যা পরবর্তীকালে হলোকাস্টের মতো নৃশংস ঘটনার দিকে নিয়ে যায়।
৩) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হতো নাঃ
হিটলারের না থাকলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু কখনোই হতো না। ১ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৯ সালে হিটলারের নেতৃত্বে পোল্যান্ড আক্রমণের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধের কারণে মিত্রশক্তি যেমন ফ্রান্স ও ব্রিটেন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। পরে আডলফ হিটলার ইতালির মুসোলিনি ও জাপানের সম্রাটের সাথে অক্ষশক্তি তৈরি করেন, যা যুদ্ধকে আরও ভয়াবহ ও দীর্ঘায়িত করে। যদি হিটলার না থাকতেন, তবে প্রায় ৬ কোটি মানুষ প্রাণ হারাতো না।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইহুদি নিধনের কারণে ৬০ লাখ ইহুদি মারা যায়, যার ফলশ্রুতিতে হলোকাস্টের স্মৃতি ইহুদিদের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবীকে আরও জোরালো করে। ফলে ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। যদি হিটলার না থাকতেন, তাহলে হয়তো ইহুদি রাষ্ট্রের জন্ম হতো না, এবং মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান সমস্যা ও যুদ্ধগুলোও হয়তো এতো প্রকট হতো না।
৫) আমেরিকার একক ক্ষমতা অর্জনঃ
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতার অন্যতম মাইলফলক ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তার অংশগ্রহণ। জাপানের পার্ল হার্বারে আক্রমণ হিটলারের মিত্রশক্তির একটি পদক্ষেপ ছিল, যার ফলে আমেরিকা সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকার অংশগ্রহণ যুদ্ধের স্রোত বদলে দেয়, এবং ১৯৪৫ সালের পারমাণবিক বোমা হামলার পর থেকে আমেরিকা একক পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। যদি হিটলার না থাকতেন, তাহলে আমেরিকার এমন অর্থনৈতিক এবং সামরিক আধিপত্য অর্জন হয়তো সম্ভব হতো না।
আরও জানুনঃ এডলফ হিটলার এর জীবনের শেষ মুহূর্তগুলোঃ একটি নজরকাড়া অধ্যায়
৬) কমিউনিজমের বিস্তার হতো নাঃ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে সোভিয়েত ইউনিয়ন পূর্ব ইউরোপের বেশ কিছু দেশ দখল করে, এবং সেখানে সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে। এই সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পরবর্তীকালে গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। উদাহরণস্বরূপ, ভিয়েতনামের হো চি মিন এবং কিউবার ফিদেল কাস্ত্রো সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলেন। যদি আডলফ হিটলার না থাকতেন, তাহলে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন এত দ্রুত গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়তো না।
৭) জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা হতো নাঃ
১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয় বিশ্বশান্তি এবং নিরাপত্তা বজায় রাখার উদ্দেশ্যে। কিন্তু হিটলারের পোল্যান্ড আক্রমণ এবং লিগ অব নেশন্সের ব্যর্থতার পর জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। হিটলার না থাকলে হয়তো লিগ অব নেশন্স দিয়েই বিশ্ব পরিচালনা হতো, এবং জাতিসংঘের মতো একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান কখনোই গড়ে উঠতো না।
৮) ইউরোপীয় উপনিবেশ বজায় থাকতোঃ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে ইউরোপের অধিকাংশ দেশ যেমন ব্রিটেন, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর ফলে, তারা তাদের আফ্রিকা এবং এশিয়ার উপনিবেশগুলো ছাড়তে বাধ্য হয়। যদি হিটলার না থাকতেন, হয়তো ইউরোপীয় উপনিবেশগুলো এখনো টিকে থাকতো, এবং অনেক দেশ আজও স্বাধীনতা অর্জন করতে পারতো না।
৯) ভারত-পাকিস্তানের জন্ম হতো নাঃ
ব্রিটিশ রাজের পতন হিটলারের আক্রমণের কারণে দ্রুততর হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে ব্রিটেন তার ক্ষমতা হারায়, এবং দ্রুত ভারত ও পাকিস্তানকে স্বাধীনতা দিতে বাধ্য হয়। হিটলার না থাকলে হয়তো ভারত-পাকিস্তান অনেক পরে স্বাধীন হতো।
আরও জানুনঃ হিটলারের অজানা ১০টি বিস্ময়কর তথ্য
১০) ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্ম হতো নাঃ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ইউরোপের দেশগুলো যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ থেকে পুনর্গঠিত হওয়ার জন্য একত্রিত হতে বাধ্য হয়। এর ফলে, ১৯৫৮ সালে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পূর্বসূরি European Coal and Steel Community গঠিত হয়। হিটলার না থাকলে ইউরোপীয় দেশগুলো হয়তো এত দ্রুত একসাথে আসতে পারতো না।
১১) পরমাণু অস্ত্র আবিষ্কার হতো নাঃ
আইনস্টাইন, অপেনহাইমার, ফার্মি—এই সকল ইহুদি বিজ্ঞানীরা হিটলারের ইহুদি বিদ্বেষের কারণে জার্মানি ছেড়ে আমেরিকায় আশ্রয় নেন। তাদের গবেষণার ফলেই আমেরিকায় পরমাণু বোমা তৈরি হয়, যা হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে ব্যবহার করা হয়। হিটলার না থাকলে হয়তো আমেরিকায় এই বৈজ্ঞানিক মস্তিষ্কগুলো পাড়ি জমাতো না এবং পরমাণু বোমা আবিষ্কৃত হতো না।
১২) স্নায়ুযুদ্ধ হতো নাঃ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয়, যা মূলত পুঁজিবাদ ও সমাজবাদের লড়াই ছিলো। হিটলার না থাকলে ফ্যাসিবাদকে ধ্বংস করার প্রয়োজন হতো না এবং হয়তো স্নায়ুযুদ্ধের পরিবর্তে পুঁজিবাদের একক বিজয় ঘটতো।
হিটলারের অস্তিত্ব না থাকলে বর্তমান পৃথিবীর চেহারা হয়তো একেবারেই ভিন্ন হতো। আমরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে শুরু করে পরমাণু বোমার ভয়াবহতা, ইসরায়েলের সৃষ্টি, বা আমেরিকার ক্ষমতার উত্থান কিছুই হয়তো দেখতাম না। হিটলারের প্রভাব যেমন ধ্বংসাত্মক ছিল, তেমনি তার না থাকার ফলে পৃথিবীও অন্য এক জটিলতায় আবর্তিত হতে পারত।
[…] […]
[…] […]